সাড়ে চুয়াল্লিশ বছর আগে যেখানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে সমাহিত করা হয়েছে, সেই জিয়া উদ্যানে স্বামীর পাশেই শায়িত হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় সাবেক বিএনপি চেয়ারপারসনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
এর আগে বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদের সামনে জনসমুদ্রের মধ্যে খালেদা জিয়ার জানাজা হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরের মাঠ, বাইরের অংশ এবং পুরো মানিক মিয়া অ্যাভেনিউ ছাড়িয়ে আশপাশের সব সড়ক, অলিগলি থেকে অজস্র মানুষ তাতে শরিক হোন।
এই মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতেই ১৯৮১ সালের ২ জুন খালেদা জিয়ার স্বামী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজা হয়েছিল। পরে তাকে সমাহিত করা হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে, যার বর্তমান নাম জিয়া উদ্যান।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় খালেদা জিয়ার।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান ছিলেন ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য স্বাধীনতার পর তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। পরে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছান।
তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।
জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া, তখন তিনি নিতান্তই একজন গৃহবধূ। তিনি ১৯৮৪ সালের অগাস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন, আমৃত্যু তিনি সে দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনে এরশাদ সরকারের সঙ্গে কখনো আপস করেননি খালেদা।
অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতা করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যায়নি। তাই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার নাম হয় আপসহীন নেত্রী।
বিগত ৪০ দিন ধরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে মঙ্গলবার ভোর ৬টায় মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। তার মৃত্যুতে দেশে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলছে, বুধবার ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ছুটি।
বুধবার সকালে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়ার কফিন নেওয়া হয় গুলশানে তার ছেলে তারেক রহমানের বাড়িতে।
পরে জাতীয় পতাকা শোভিত লাশবাহী গাড়ি বেলা পৌনে ১২টার দিকে সংসদ ভবনের সামনে পৌঁছায়। গাড়িবহরে একটি বাসে করে সেখানে পৌঁছান খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা। বাদ জোহর খালেদা জিয়ার জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও তার আগেই সংসদ ভবন এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়।
জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ দলের সর্বস্তরের নেতারকর্মীদের পাশাপাশি জামায়াত ইসলামীর শফিকুর রহমান, মিয়া গোলাম পরওয়ার, শামীম সাঈদী, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এনসিপির নাহিদ ইসলাম ও হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরকে দেখা গেছে। ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের আহমাদুল্লাহও বিএনপি নেত্রীর জানাজায় অংশ নেন।
জানাজার আগে পরিবারের তরফে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান প্রয়াতের জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
তিনি বলেন, “আমি মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান। আজকে এখানে উপস্থিত সকল ভাইয়েরা এবং বোনেরা মরহুমা বেগম খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যদি আপনাদের কারো কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি সেটি পরিশোধের ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ।
“একই সাথে উনি জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় উনার কোনো ব্যবহারে, উনার কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। দোয়া করবেন। আল্লাহ তাআলা যাতে উনাকে বেহেশত দান করেন।”
বিএনপি নেতা তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে দেড় দশকের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে গেল বৃহস্পতিবার সপরিবারে দেশে ফেরেন। এর এক সপ্তাহের মধ্যে তার মাতৃবিয়োগ ঘটল। এরইমধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম চলায় দলের নেতৃত্বের দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে তাকে।
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাবিক, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডি এন ধুঙ্গেল, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির উচ্চ শিক্ষা, শ্রম ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী আলি হায়দার আহমেদ, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালা নন্দা শর্মা, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিজিতা হেরাথ।
চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন মিশনের প্রধানরাও তাদের দেশের পক্ষে খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা জানাতে মানিক মিয়া অ্যাভেনিউয়ে শেষ যাত্রায় অংশ নিয়েছেন।
News আরও একটি ওয়ার্ডপ্রেস সাইট